বাংলাদেশের লোকায়ত শিল্পের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্ভবত সবচেয়ে গর্বের জিনিস তাঁতশিল্প ও তাঁতবস্ত্র। মসলিন থেকে জামদানী কিংবা টাঙ্গাইল শাড়ি এর উদাহরণ। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের তাঁত প্রধান অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা কিছু গুরুত্বপূর্ণ হাট আবহমান কাল থেকে তাঁতবস্ত্র বিপণনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। এই সব হাট থেকে দেশের বাইরেও একসময় তাঁতবস্ত্র রপ্তানি করা হতো। তাঁতশিল্পের সেই সোনালী দিন আজ গত। তারপরেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তের তাঁত প্রধান অঞ্চলগুলোর কিছু হাট বস্ত্র বিপণনের সনাতনী ধারা জারি রেখে এখনও সগৌরবে সচল রয়েছে। বিদেশে না হোক, এই সব হাট বর্তমানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁতবস্ত্রের চাহিদা পুরণ করে চলেছে বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের উত্থানপতনের নিরব সাক্ষী হয়ে। তাঁতশিল্পের নিরিখে নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া-জয়পুরহাট, খুলনার খ্যাতি সুদীর্ঘকাল থেকে। তাই তাঁতপ্রধান এই অঞ্চলগুলোতে এখনও রয়েছে তাঁতবস্ত্র বিপণনের সবচেয়ে বড় হাটগুলো। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের তাঁতবস্ত্রের চাহিদা মেটানো হয় এই হাটগুলো থেকে।
মাধবদী বাবুর হাট, নরসিংদী
মাধবচন্দ্র গুপ্ত রায় নামে একজন জমিদারের নামানুসারে নরসিংদী জেলার বর্তমান মাধবদী অঞ্চলের নামকরণ করা হয়। ১৮ শতকের শেষ পর্যায়ে মাধবদীর উত্তর দিকে আনন্দী গ্রামে কাজীর হাট নামে সপ্তাহে একটি হাট বসত, বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত। বিভিন্ন কারণে এই হাটটি একপর্যায়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে ১৯ শতকের প্রথম দিকে স্থানীয় জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় মাধবদীতে প্রতি সোমবার একটি হাট বসতে শুরু করে। জমিদার বাবুরা হাটের পৃষ্ঠপোষক থাকার কারণে স্থানীয় লোকজনের কাছে এই হাটটি বাবুর হাট হিসেবে পরিচিতি পায়। আর যেহেতু এটি মাধবদী গ্রামে অবস্থিত তাই গ্রামের নাম যোগ করে মাধবদী বাবুর হাট নামকরণ করা হয়।
এই হাটটি প্রথম দিক থেকেই তাঁতে তৈরি বস্ত্র বিপননের জন্য বিখ্যাত ছিল। কারণ মাধবদী এবং এর আশেপাশের আলগী, বিরামপুর, আনন্দীসহ বিভিন্ন গ্রামে হস্তচালিত তাঁতে স্থানীয় অধিবাসীরা, বিশেষত যুগী সম্প্রদায়ের মানুষজন বস্ত্র বয়ন করত। সপ্তাহান্তে তাঁতবস্ত্র বিপননের ফলে কাঁচা টাকা পাওয়া যায়। সঙ্গত কারণে তাঁতের কাজ পুরো অঞ্চলের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে এই হাটের পরিধি এবং পরিচিতি দুটোই বৃদ্ধি পায়। এই বিখ্যাত হাটটি বৃটিশ আমলে প্রথমবারের মতো ভেঙ্গে যায় মূলত জমিদারদের অধিক খাজনা আদায়কে কেন্দ্র করে। এই সুযোগটি লুফে নেন মাধবদীর পাশের জমিদার হলধর সাহা (কালু সাহা)। তিনি ঘোষণা দেন যে, ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব তীরে শেখের চরের বাঁকমোড়া নামক স্থানে তিনি একটি হাট প্রতিষ্ঠা করবেন। এখানে ব্যবসা করার জন্য তাঁতি ও মহাজনদের কোন প্রকার টোল দিতে হবে না। এ ঘটনার কিছুদিনের মধ্যে বাবুর হাট ভেঙ্গে যায় এবং শেখের চরের বাঁকমোড়ায় একটি নতুন হাটের পত্তন হয়। এর পরপরই বাবুর হাটের জায়গায় শেখের চর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে বস্ত্র বিপননের কেন্দ্র হিসেবে। এতকিছু সত্ত্বেও বাবুর হাট একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। কারণ শেখের চর বস্ত্র বিপননের কেন্দ্র হলেও তাঁতশিল্পের যাবতীয় উপকরন যেমন, রং, সুতা, তাঁতযন্ত্র ইত্যাদি এখানে পাওয়া যেত। ফলে বাবুর হাট অল্পদিনের মধ্যে পুণঃরায় তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে। লোকজনের মধ্যে শেখের চরের হাটটিকে ‘শেখের চর বাবুর হাট’ এবং মাধবদীর হাটটিকে ‘মাধবদী বাবুর হাট’ নামে ডাকার প্রচলন হয়। হাট দুটি এক মাইলের মধ্যে অবস্থিত। এখনও স্থানীয়দের মধ্যে একটি মাধবদী বাবুর হাট আর অন্যটি শেখের চর বাবুর হাট হিসেবে পরিচিত। আর বাইরের মানুষদের কাছে দুটি হাটই বাবুর হাট হিসেবে পরিচিত।
জানা যায়, ক্রমে ক্রমে বাবুর হাটের সুখ্যাতি আঞ্চলিক গণ্ডি পেরিয়ে সর্বভারতীয় হয়ে পরে। ফলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বস্ত্র ব্যবসায়ীরা নৌপথে বাবুর হাটের সাথে ব্যবসায়ীক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। এই ধারা অব্যাহত থাকে ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিˉ—ান যুদ্ধ পর্যন্ত। ১৯৬৫ সালের রাজনৈতিক উত্তেজনা ও যুদ্ধের কারণে এবং ক্রমে নৌপথ ব্যবহার সংকুচিত হয়ে পড়ার ফলে ভারতীয় বস্ত্রব্যবসায়ীরা বাবুর হাটের সাথে তাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলে। তবে বর্তমানেও এই হাটটি বাংলাদেশের বড় তাঁতবস্ত্র বিপনন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখনও এই হাটে সোমবার সর্বাধিক ক্রয়-বিক্রয় হয়ে থাকে। এখান থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মহাজন ও তাঁতের কাপড় ব্যবসায়ীরা শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, মশারি, বিছানার চাদর, ছাপা কাপড় ইত্যাদি কিনে নিয়ে যায়। তবে এটি বর্তমানে লুঙ্গি বিক্রির একটি বড় কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। স্ট্যান্ডার্ড, এটিএম, অনুসন্ধান ইত্যাদির মতো দেশের বড় বড় লুঙ্গির কোম্পানিগুলো তাদের বিক্রিত লুঙ্গির একটা বড় অংশ কেনে এখান থেকে।
বাজিতপুর হাট, টাঙ্গাইল
দেলদুয়ারের পুঠিয়াজানি হাট টাঙ্গাইল অঞ্চলের পুরনো হাটগুলোর মধ্যে অন্যতম। বেশি তোলা/টোল আদায়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই হাট ভেঙ্গে বাজিতপুর হাটের পত্তন হয় ১ ফাল্গুন ১৩৬১ বঙ্গাব্দে (আনুমানিক ১৯৫৪ সালে)। এই হাটের পত্তনকারীদের মধ্যে গফুর মোল্লা, আসান ভূঁইয়া, রঘুনাথ বসাক, আলাউদ্দিন তালুকদার এই চার জনের নাম পাওয়া যায়। শোনা যায়, রঘুনাথ বসাকের দান করা জমির উপরে বাজিতপুরের হাটের যাত্রা শুরু হয়েছিল। বর্তমানে টাঙ্গাইল শাড়ি বিক্রির সবচেয়ে বড় হাট এটি।
শুক্র ও সোমবার, সপ্তাহের এই দুই দিন বসে বাজিতপুরের হাট। শুক্রবারের হাট জমজমাট হয় বেশি। ভোরে শুরু হয়ে সকাল ১০Ñ১১টার মধ্যে হাট শেষ। বাজিতপুর, পাথরাইল, বল্লাসহ টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকার তাঁতি ও মহাজনরা এই হাটে আসে শাড়ি বিক্রির জন্য। এছাড়া পার্শ্ববর্তী সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের এনায়েতপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর থেকে সুতার ব্যবসায়ীরা এখানে সুতা বিক্রির জন্য আসে। চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, দিনাজপুর প্রভৃতি স্থানের মহাজনরা এখানে আসে টাঙ্গাইল শাড়ি কিনতে। সেই শাড়ি দেশের বিভিন্ন শহরের বড় বড় দোকান ও বুটিক শপে বিক্রি হয়। বাজিতপুর হাটে মোটামুটি দুইভাবে শাড়ি বিক্রি হয়। পেটি করে এবং পিচ হিসেবে। দামি শাড়ি (যেগুলোর দাম ৩,৫০০ টাকা বা তার বেশি) পাঁচ পিচে এক পেটি এবং কম দামি শাড়ি (১,৮০০ টাকা-২,৫০০ টাকা) দশ পিচে এক পেটি। এখানে শাড়ি ও সুতা বিক্রির জন্য স্থায়ী দোকানগুলোর পাশাপাশি অনেক ভ্রম্যমান দোকান বসে হাটের দিনে। বড় কাপড় ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি এখানকার অনেক প্রান্তিক তাঁতি ফেরি করে বিক্রি করে বিখ্যাত টাঙ্গাইল শাড়ি।
ডেমরা হাট, ঢাকা
জামদানী শাড়ি বিপননের বিখ্যাত ডেমরা হাট শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে ঢাকা জেলার ডেমরা এলাকায় অবস্থিত। এই হাটের উৎপত্তি সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। স্থানীয় তাঁতি এবং সাধারণ লোকজনের বক্তব্য, এই হাট প্রায় ২০০/৩০০ বছরের পুরন। ২০০৮ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে ডেমরা হাটে টিনের শেড দেয়া ‘জামদানী কমপ্লেক্স’ এর উদ্বোধন করা হয়। এর আগে খোলা আকাশের নিচে এই হাট বসত।
এই হাট বসে সপ্তাহে এক দিনÑ শুক্রবার। ভোর সাড়ে চার/পাঁচটা থেকে হাট শুরু হয়, সকাল ৯/১০টার মধ্যেই শেষ। শীতলক্ষ্যা ও বালি নদী পেরিয়ে তাঁতিরা এখানে জামদানী শাড়ি বিক্রি করতে আসে নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মহাজন এবং বিভিন্ন বুটিক হাউজের লোকজন এখানে জামদানী শাড়ি কিনতে আসে পাইকারি দামে। তাঁতিরা হাতে হাতে শাড়ি বিক্রি করে। তাঁতিদের সাথে দরদাম করে প্রয়োজন ও পছন্দ মতো জামদানী শাড়ি কেনা যায় এখানে। দুই ভাবে বিপনন চলে জামদানী শাড়িরÑ মহাজন ও তাঁতি সরাসরি এবং ফড়িয়া/মধ্যস্বত্ত্ব ভোগিদের মাধ্যমে।
যে জামদানী শাড়ির ডিজাইন যত বেশি ভারি সে শাড়ির দামও তত বেশি। হাটে সাধারণত ১,৫০০ টাকা থেকে ৫,০০০ হাজার টাকা দামের শাড়ি বিক্রি হয়। তবে কখনও কখনও বেশি দামের শাড়িও এখানে বিক্রি হয়। ঈদ বা পূজার মতো বিশেষ পার্বনের সময় এখানে শাড়ির চাহিদা বেশি থাকে।
শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড়ে রয়েছে নোয়াপাড়া এবং তারাব হাট। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব তীরে নোয়াপাড়া এলাকায় একটি জামদানী পল্লী তৈরি করেছে। এখানে একটি হাটও রয়েছে জামদানী বিপননের জন্য। এই হাটটি বিসিকের হাট নামে পরিচিত। অবশ্য জামদানী বিপণনের প্রাচীন হাট হিসেবে ডেমরা হাটই প্রসিদ্ধ এখনও পর্যন্ত।
ফুলতলা হাট, খুলনা
বর্তমানে খুলনা অঞ্চল তাঁতশিল্পের নিরিখে তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলেও এই অঞ্চলের তাঁতশিল্পের অতীত ইতিহাস বেশ উজ্জ্বল। খুলনার জেলার গাড়াখোলা, আলকা, দামদর, জামিরা, যুগনীপাশা, পাবলা প্রভৃতি গ্রাম বর্তমানে এই অঞ্চলের তাঁতশিল্পের স্মৃতি বহন করে চলেছে। এই গ্রামগুলোতে আজ থেকে এক দশক পূর্বেও বয়ন করা হতো শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, ধুতি ইত্যাদি। বর্তমানে এই গ্রামগুলোতে শুধুই গামছা বোনা হয়। এই গামছা বিপননের প্রধান কেন্দ্র ফুলতলা হাট বসে সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার। ভৈরব নদের তীরে খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলা সদরে গামছা বিক্রির জন্য বিখ্যাত ও প্রাচীন হাটটি অবস্থিত। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মহাজনেরা এখানে আসে রংবেরঙের গামছা কিনতে। গামছা বিক্রি হয় থান হিসেবে। চারটি গামছায় এক থান। কিছু কিছু মহাজন এখানে তাদের স্থায়ী ‘গদি’ ঘর নির্মাণ করেছে। প্রতি হাটবারে তারা বিপুল পরিমানে গামছা কিনে মজুদ করে। পরে সুবিধামত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এগুলো পাঠানো হয়। বাংলাদেশে এককভাবে গামছা বিক্রির সবচেয়ে বড় হাট হিসেবে পরিচিত এটি।
ভৈরব নদের অপর পারেই যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলা। অভয়নগরের সিদ্ধিপাশা অঞ্চল তাঁতবস্ত্র বয়নের জন্য বিখ্যাত ছিল একসময়। এই অঞ্চলেও বর্তমানে খুবই সীমিত পর্যায়ে শাড়ি, লুঙ্গি তৈরি হয়। এখানেও গামছা উৎপাদন বেশি। এই এলাকার তাঁতিরাও তাদের গামছা বিপননের জন্য আসে ফুলতলা হাটে। বলা চলে, খুলনা জেলার যেসব গ্রামে বর্তমানে গামছা তৈরি হয় তাদের সবাই এবং পার্শ¦বর্তী যশোরের বিভিন্ন গ্রাম থেকেও তাঁতিরা আসে ফুলতলা হাটে। মূলত নব্বইয়ের দশক থেকে খুলনা এবং যশোরের কিছু কিছু এলাকায় তাঁতপণ্য হিসেবে শাড়ি, লুঙ্গি, ধুতির উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে ওইসব অঞ্চলের তাঁতিরা অধিক পরিমানে গামছা উৎপাদন শুরু করে। এর ফলে ফুলতলা ধিরে ধিরে গামছা বিক্রির হাট হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
কুমারখালী হাট, কুষ্টিয়া
বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলা জনপদ হিসেবে অনেক পুরনো এবং তাঁতবস্ত্র বয়নের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভাগপূর্ব কালে কুষ্টিয়া অঞ্চলে গড়াই নদীর উত্তর তীরে পন্টি নামের একটি হাট তাঁতবস্ত্র বিপননের জন্য বিখ্যাত ছিল বলে জানা যায়। বিভিন্ন সূত্র থেকে যতদূর জানা যায়, পন্টি এবং কুমারখালী অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে বিভিন্ন কারণে বিরোধ দেখা দিলে কুমারখালী হাটের জন্ম হয়।
১৮৬৯ সালে কুমারখালী পৌরসভা গঠিত হলে এই এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। ফলে কুমারখালি হাট অন্যসব হাটকে পেছনে ফেলে দ্রুতই খ্যাতি অর্জন করে। কুষ্টিয়ার কুমারখালী ও খোকসা উপজেলাসহ এই অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে পূর্বে বিভিন্ন তাঁতবস্ত্র তৈরি হলেও বর্তমানে এই অঞ্চল লুঙ্গি ও গামছা তৈরির জন্য বিখ্যাত। সঙ্গত কারণে কুমারখালী হাট বর্তমানে লুঙ্গি ও গামছা বিপননের জন্য বিখ্যাত। তবে গামছার চেয়ে এই হাটে লুঙ্গি বিক্রি হয় বেশি। কারণ কুমারখালী পৌরসভাধীন এলাকায় এবং দুর্গাপুর, তারাপুর, বকশীসাতপাকিয়া, হোগলা প্রভৃতি এবং খোকসা উপজেলার সন্তোষপুর, গোপকগ্রাম, আমলাবাড়িসহ বিভিন্ন গ্রামে বর্তমানে মোটা সুতায় কম দামের লুঙ্গি তৈরি হয়। এইসব গ্রামে তৈরিকৃত লুঙ্গি ও গামছা বিক্রি হয় কুমারখালী হাটে। এই অঞ্চলে ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় আট-ন’শো তাঁতের কারখানা রয়েছে বলে জানা যায়। বুলবুল, ইস্টার্ন, রানা, নূর, ইলোরা, কাওছার নামের বড় বড় তাঁত কারখানা রয়েছে এখানে। এইসব কারখানায় উৎপাদিত বস্ত্রের মধ্যে বেশিরভাগই লুঙ্গি। এই অঞ্চল বাংলাদেশের লুঙ্গি শিল্পে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে। উল্লেখ করা যেতে পারে, নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত গ্রামীণ জনসাধারণের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠা নিক্তি, জবা ইত্যাদি ব্রান্ডের সˉ—ার লুঙ্গিগুলো এই অঞ্চলেই উৎপাদিত হতো। এই লুঙ্গিগুলো মূলত ৪০-৬০ কাউন্টের মোটা সুতি সুতায় তৈরি হতো। এই সব লুঙ্গি বিপননের জন্য কুমারখালী হাট সারা দেশে খ্যাতি অর্জন করে। লুঙ্গির পাশাপাশি এখানে শাড়ি, গামছা, বিছানার চাদর, মশারি, ছিট কাপড় ইত্যাদি পণ্য বিক্রি হয়। বড় বড় মহাজনের ‘গদি ঘর’ রয়েছে এখানে। স্থানীয় মহাজন ছাড়াও পার্শ্ববর্তী পাবনা, চুয়াডাঙ্গ, যশোর, খুলনা এবং উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার মহাজনরা এখানে পাইকারী দামে তাঁতবস্ত্র কিনতে আসে হাটের দিন।
শাহজাদপুর হাট ও সোহাগপুর হাট , সিরাজগঞ্জ
বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের নিরিখে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল সিরাজগঞ্জ। তাঁতবস্ত্র বিপননের জন্য এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি বড় হাট রয়েছে। এগুলোর মধ্যে শাহজাদপুর ও সোহাগপুর হাট অন্যতম।
শাহজাদপুর হাট বসে সপ্তাহে দুই দিন- রবি ও বুধ বার। এটি মূলত সুতা বিপননের জন্য বিখ্যাত। বাংলাদেশের যে কয়েকটি সুতার বড় বাজার রয়েছে, তার মধ্যে শাহজাদপুর অন্যতম। এখান থেকে পাইকারি সুতা বিক্রি করা হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষত উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায়। সাদা সুতা ছাড়াও এখানে রঙিন সুতা পাওয়া যায়। সুতা ছাড়াও এখানে বিক্রি করা হয় মূলত শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা। এছাড়া ছিট কাপড়, গজ কাপড়, বিছানার চাদর, মশারিও এখানে বিক্রি হয়।
সোহাগপুর হাটের বর্তমান অবস্থান সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার মুকুন্দগাতি মৌজায়। মুকুন্দগাতি থেকে পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে মূল সোহাগপুর হাটের অˉি—ত্ব ছিল ’৮০র দশকে। পরবর্তীতে যমুনা নদীর ভাঙ্গনের ফলে নাম অপরিবর্তিত রেখে হাটটি মুকুন্দগাতিতে উঠে আসে। সোম, মঙ্গল ও বুধবার বসে এই হাট। সম্ভবত সিরাজগঞ্জ এলাকায় সবচেয়ে বড় কাপড়ের হাট এটি। সোমবার কেনাবেচা হয় ‘গ্রে’ লুঙ্গির, মঙ্গল বার শাড়ি, থ্রিপিচসহ অন্যান্য ‘রেডি’ তাঁতবস্ত্রের এবং বুধবার সুতার বিকিকিনি হয় এখানে। গ্রে লুঙ্গির ব্যবসাই এই হাটের বিশেষত্ব। গ্রে হচ্ছে তাঁত থেকে (এবং পাওয়ার লুম থেকেও) নামিয়ে ক্যালেন্ডার ও সেলাই না করে থান হিসেবে বিক্রি করা লুঙ্গি। আর রেডি হচ্ছে কারখানা মালিকের নিজস্ব ব্রান্ডের প্রোসস করা লুঙ্গি। এই এলাকার তামাই গ্রামের ৮-১০ জন তাঁতির নিজস্ব ব্রান্ডের লুঙ্গি রয়েছে। সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার তাঁতিরা এখানে আসে তাঁতবস্ত্র বিপননের জন্য। এখানে স্ক্রিন প্রিন্টের কয়েকটি কারখানা রয়েছে। এই কারখানাগুলোতে তাঁতের বা পাওয়ার লুমে তৈরি শাড়িতে স্ক্রিন প্রিন্ট করা হয় এবং এগুলো কম দামে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বিশেষত উত্তরাঞ্চলের মহাজনদের কাছে বিক্রি করা হয়। সিরাজগঞ্জের তাঁতের লুঙ্গি বেশ বিখ্যাত। এখানে ৮০-১০০ কাউন্ট সুতি সুতায় তৈরি উন্নত মানের লুঙ্গি বয়ন করা হয়। এই হাট দুটি ছাড়াও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের তাঁতবস্ত্র বিপণনে এনায়েতপুর ও পোড়াদহের হাট অন্যতম।
শাওয়াইল হাট, বগুড়া
শাওয়াইল হাট বগুরা জেলার আদমদীঘি উপজেলার শাওয়াইল ইউনিয়নের শাওয়াইল গ্রামে অবস্থিত। প্রতি রবি ও বুধবার এই হাট বসে। খুব কম দামে তাঁতে তৈরি আরামদায়ক ও রংবেরঙের উলের কম্বল পাওয়া যায় এখানে। শীতকালে ঢাকা শহরের ফুটপাথে সˉ—ার যে রংবেরঙের উলের চাদর ও কম্বল পাওয়া যায় তার বড় অংশই আসে শাওয়াইল হাট থেকে।
শীত বস্ত্রের হাট বলে শাওয়াইল হাট জমজমাট হয় আশ্বিন থেকে মাঘ মাসের মাঝামাঝি সময়ে। গ্রীষ্ম কাল ‘অফ সিজন’। বগুরা ও জয়পুরহাট জেলার বিভিন্ন গ্রামের তাঁতিরা তাঁতে এই চাদর ও কম্বল তৈরি করে থাকে। এই এলাকায় দুই দশক আগে শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, ফোতা, ধুতি তৈরি হলেও বর্তমানে এই অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে অল্প সংখ্যক তাঁতি গামছা, লুঙ্গি ও মশারি বয়ন করে। আশির দশকের শেষের দিকে শাওয়াইল হাটে উলের সুতা বিক্রি শুরু হয় বলে জানা যায়। ঢাকা এবং গাজীপুরের বিভিন্ন সোয়েটার কারখানার ‘ঝুট’ কাপড় মণ হিসেবে কিনে নিয়ে আসে এখানকার ব্যবসায়ীরা। সেই ঝুট থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সুতা তৈরি করে এখানকার নারীরা। এখান থেকে উলের সুতা কিনে নিয়ে যায় রংপুরের শতরঞ্জি পাড়ার কারিগরেরা, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রাজশাহী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড়ের তাঁতিরা। এখানে কটন ‘দোতার’ (টুইস্ট) সুতাও পাওয়া যায়। এই সুতা দিয়ে গামছা, তোয়ালে তৈরি হয়। স্থানীয় তাঁতিদের ব্যতিক্রমী উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং পরবর্তিতে সুতি সুতার দাম বৃদ্ধিসহ নানান কারণে এই এলাকায় উলের সুতা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর ফলে তাঁতিরা উলের সুতা দিয়ে তৈরি শুরু করে চাদর ও কম্বল। এই চাদর ও কম্বল এবং উলের সুতা বিপণনের জন্য শাওয়াইল হাট বিখ্যাত হয়ে ওঠে অল্প দিনের মধ্যে।
তাঁতবস্ত্র বিপণনের জন্য বিখ্যাত এই হাটগুলোতে তাঁতিদের সাথে দরদাম করে যে কেউ পছন্দ মতো কাপড় কিনতে পারে। আর যাইহোক নগরকেন্দ্রিক বুটিক হাউজগুলোর উচ্চ মূল্যের ট্যাগের নিচে গলা বাড়িয়ে না দিয়ে একটু কষ্ট করে এইসব হাট থেকে তাঁতের কাপড় কেনা সম্ভব। যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা তাঁতশিল্পের বিপণন প্রক্রিয়ার সনাতনী রূপ প্রত্যক্ষ করার সুযোগও রয়েছে এই হাটগুলোতে।